অ্যাডলফ হিটলার ছিলেন জার্মান নাৎসিবাদের তাত্ত্বিক ও প্রায়োগিক নেতা। এরই তত্ত্ব তিনি উপস্থাপন করেছেন ১৯২৪ সালে তার রচিত আত্মজীবনীমূলক বই Mein Kampf (আমার সংগ্রাম)-এ। এটিকে নাৎসিবাদের বাইবেল রূপে আখ্যায়িত করা হয়।
নাৎসিবাদের সুচনালগ্ন এবং সৃষ্টি সম্পর্কে জানতে এই অংশ আগে পড়ে নিন ।
অ্যাডলফ হিটলার - এর কর্মকাণ্ড
অ্যাডলফ হিটলার - এর কর্মকাণ্ড |
হিটলার তার আত্মজীবনীমুলক বই Mein Kampf- এ তিনি জার্মান বিশুদ্ধ রক্তের তত্ত্ব হাজির করেন। একটি শক্তিশালী রাষ্ট্র ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে পৃথিবীতে জার্মানদের শ্রেষ্ঠত্ব কায়েম করার হিটলারী ধারণা উপস্থাপন করেন।
হিটলার তার গ্রহে ফরাসিদের নিন্দা করেছেন, জার্মানদের আপসহীন শত্রু বলে অভিহিত করেছেন। একই সঙ্গে পূর্ব ইউরোপকে জার্মানির উপনিবেশ হিসেবে গণ্য করা হয়েছে। আশপাশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা সংখ্যালঘু জার্মানদের জার্মানির সঙ্গে একত্রিত করার ইচ্ছা ব্যক্ত করেন হিটলার।
মূলত হিটলার জার্মানিকে পুনরায় বিপুল সামরিক সম্ভারে সজ্জিত করার মাধ্যমে প্রথম বিশ্বযুদ্ধে জার্মানির কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার অসমাপ্ত পরিকল্পনার বাস্তবায়ন ঘটানো, ভার্সাই চুক্তিতে লাভবান শক্তির বিরুদ্ধে প্রতিশোধ নেওয়া এবং জার্মানিকে সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী রাষ্ট্ররূপে প্রতিষ্ঠা করার পরিকল্পনা ছিল।
এর জন্যে যুদ্ধই ছিল হিটলারের একমাত্র নির্দেশিত পথ। কোনো রাজনৈতিক সুস্থ চিন্তাধারার প্রবর্তন তাতে ছিল না।
আরও পড়ুন...
হিটলার ক্ষমতায় আসার ক্ষেত্রে জার্মান উগ্র জাতীয়তাবাদের জিগির তুলেছিলেন, জার্মান তরুণদের স্বপ্ন দেখিয়েছিলেন, ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয়ে নগ্নভাবে সমরবাদে জার্মান রাষ্ট্রকে সজ্জিত করেছেন, অন্য জাতি ও রাষ্ট্রকে নিশ্চিহ্ন করার বিনিময়ে জার্মান শ্রেষ্ঠত্ব প্রতিষ্ঠিত করতে সকল শক্তি নিয়োগ করেছেন।
এ ক্ষেত্রে হিটলার ছিলেন অদ্বিতীয়। হিটলার নাৎসিবাদকে গ্রন্থাকারে তুলে ধরেছেন-যা বাইবেলের মতো পবিত্রজ্ঞাত করে একসময় জার্মানিতে পঠিত হয়েছিল।
জার্মানির লাইব্রেরি থেকে জ্ঞানী, বিজ্ঞানী-দার্শনিকদের বই-পুস্তক অপসারণ করা হয়েছিল, পুড়িয়েও ফেলা হয়েছিল।
হিটলারের তত্ত্ব নিয়ে জার্মানিতে এক সময় রাষ্ট্রীয় উন্মাদনা ছড়ানো হয়েছিল। জার্মান জ্ঞান-বিজ্ঞানীদের অনেকেই তখন আত্মরক্ষায় দেশ ত্যাগ করেন। হিটলারের জার্মান নাৎসিবাদকে ১৯২৪-পরবর্তী সময়ে একমাত্র জার্মান মতাদর্শ হিসেবে প্রচার করা হয়।
হিটলারের তত্ত্ব নিয়ে জার্মানিতে এক সময় রাষ্ট্রীয় উন্মাদনা ছড়ানো হয়েছিল। জার্মান জ্ঞান-বিজ্ঞানীদের অনেকেই তখন আত্মরক্ষায় দেশ ত্যাগ করেন। হিটলারের জার্মান নাৎসিবাদকে ১৯২৪-পরবর্তী সময়ে একমাত্র জার্মান মতাদর্শ হিসেবে প্রচার করা হয়।
মুসোলিনি ইতালিতে ফ্যাসিবাদের প্রধান নেতা হলেও তিনি হিটলারের মতো বাগ্মি নেতা বা গ্রন্থপ্রণেতা ছিলেন না। ইতালিদের মধ্যে উগ্র জাতীয়তাবাদের ধারণা দেওয়ার চেষ্টা তিনি করলেও ইতালি রক্তের শ্রেষ্ঠত্ব তিনি দাবি করেননি, ইতালিকে তিনি একমাত্র রাষ্ট্ররূপেও কল্পনা করেননি।
এ ক্ষেত্রে মুসোলিনি নিজে যেমন দুর্বল ছিলেন, ইতালিও দুর্বল ছিল। ইতালি ফ্যাসিবাদের ভিত্তি ’জাতীয় ঐক্যের’ ঐতিহাসিক লোকজ ঐতিহ্যকে রাজনীতিতে মুসোলিনি ব্যবহার করতে সক্ষম হয়েছিলেন।
তখন সময়টি ছিল এ ধরনের সস্তা আবেগ সৃষ্টির জন্যে অনুকুল। মুসোলিনি তা একটি পর্যায় পর্যন্ত করতে পেরেছিলেন-যার পরিণতি ইতালির জন্যে শেষ পর্যন্ত সুখকর হয়নি।
হিটলার অনেক বেশি উগ্রভাবে করেছিলেন যার পরিণতি হিটলার জার্মানি এবং বিশ্ব সভ্যতার জন্যে অত্যন্ত ক্ষতিকর হয়েছিল। হিটলার সেই ধ্বংসযজ্ঞের মূল হোতা ছিলেন, মুসোলিনি ছিলেন তার অনুজ, অনুগত সহচর মাত্র।
হিটলারের নাৎসিবাদের প্রায়োগিক কর্মকাণ্ড
হিটলার ১৯১৯ সালে German Workers Party-তে যোগদান করেন। তিনি ছিলেন সুবক্তা। তাই অল্প দিনের মধ্যে দলের নেতাকর্মীদের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে সক্ষম হন তিনি।
১৯২১ সালে দলের নাম পরিবর্তন করে রাখা হয় National Socialist caperman Workers Party সংক্ষেপে নাৎসি পার্টি। পরই তিনি এই দলের প্রধান নেতারূপে আবির্ভূত হন।
জার্মান ভাষায় তাকে Fuhrer অর্থাৎ মহান নেতা নামে সম্বোধন করা হতো। তাঁর Mein Kampf গ্রন্থ রচনার পর রাজনীতিতে তাকে নিয়ে দল থেকে যে আবেগ সৃষ্টি করা হয় তা পরবর্তী রাষ্ট্রীয় ভক্তিবাদে রূপান্তরিত হয়।
১৯৩২ সালের জুন মাসের নির্বাচনে উগ্র জাতীয়তাবাদ, রুশ-ফরাসি বিরোধী প্রচারণায় নাৎসিবাদী দল সফল হয়। ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হন হিটলার।
১৯৩২ সালের জুন মাসের নির্বাচনে উগ্র জাতীয়তাবাদ, রুশ-ফরাসি বিরোধী প্রচারণায় নাৎসিবাদী দল সফল হয়। ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হন হিটলার।
হিটলার ক্ষমতা গ্রহণের পরই গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠান ভাঙার উৎসবে মেতে ওঠেন। হিটলার জার্মান আইন সভার অনুমোদন ছাড়া আইন প্রণয়ন ও অনুমোদন প্রদান করতে থাকেন।
দেশের অর্থনীতিকে পুনরুজ্জীবিত করতে শিল্প, কৃষি সামরিক খাতে কলকারখানা স্থাপন, ট্রেড ইউনিয়ন নিষিদ্ধকরণ, শ্রমিক সংঘ গঠন, কয়লা, লোহা, ইস্পাত শিল্প তৈরি করেন। এতে বেকার সমস্যার লাঘব ঘটতে শুরু করে।
আরও পড়ুন...
হিটলার জার্মানিকে সামরিক শক্তিতে সজ্জিত শুরু করেন। তিনি এসব বাহিনী গঠন করেন। এই বাহিনীর প্রধান ছিলেন রোহেম।
রাইখস্টাগে আগুন জ্বালানোর অভিযোগ এনে কমিউনিস্টসহ সকল গণতান্ত্রিক শক্তিকে দমন করা হলো, কেবল নাৎসিদের রাজনীতি করার অধিকার রেখে বাকিদের ওপর কঠোর নির্যাতন চালানো হলো, তাদের কার্যক্রম বেআই ঘোষণা করা হলো।
শুধু তাই নয়, এসব বাহিনীর প্রধান রোহেম এবং তার প্রধান সমর্থকদের হিটলার ১৯৩৪ সালের ৩০ জুন হত্যা করেন। ইতিহাসে এটিকে Bloody Saturday বলা হয়।
একইভাবে সেনাবাহিনীতেও শুদ্ধি অভিযান চালিয়ে ফিল্ড মার্শাল ব্লুমবার্গ এবং ফিজকে ক্ষমতাচ্যুত করা হয়। এভাবেই জার্মানিকে নাৎসিকরণ করা হতে থাকে।
শিক্ষা, সংস্কৃতিসহ সব কিছুকে রাইখের চেম্বার অব কালচারের অধীন করা হয়। সন্দেহভাজনদের তথাকথিত জনতার বিচারালয়ে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়।
শিক্ষা, সংস্কৃতিসহ সব কিছুকে রাইখের চেম্বার অব কালচারের অধীন করা হয়। সন্দেহভাজনদের তথাকথিত জনতার বিচারালয়ে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়।
ইহুদিদের কুখ্যাত কনসেনট্রেশন ক্যাম্পে প্রেরণ করা হয়, গ্যাস চেম্বারেও নিক্ষেপ করা হতে থাকে। জার্মান গোয়েন্দা সংস্থা গেস্টাপো সাধারণ মানুষের জীবন ও চলাচল বিপন্ন করে তোলে। তারাই যে কোনো মানুষকে ধরে শাস্তি প্রদান করতে থাকে।
ফলে জার্মানি আমলা শাসিত একনায়ক রাষ্ট্রে পরিণত হয়। এর মূছিলেন ফুয়েরের হিটলার।
হিটলার অচিরেই ইতালি ও জাপানের সঙ্গে মৈত্রী গঠনের মাধ্যমে ফ্রান্স, ব্রিটেন এবং সোভিয়েত ইউনয়নের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার পরিকল্পনা থেকে জোট গঠন করেন।
হিটলার অচিরেই ইতালি ও জাপানের সঙ্গে মৈত্রী গঠনের মাধ্যমে ফ্রান্স, ব্রিটেন এবং সোভিয়েত ইউনয়নের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার পরিকল্পনা থেকে জোট গঠন করেন।
সমগ্র জার্মান জাতিকে তিনি আগে সেভাবে প্রস্তুত করেন। নিজস্ব পরিকল্পনা বাস্তবায়নের লক্ষ্যে তিনি অগ্রসর হন। শান্তির বুলির অন্তরালে তিনি বড় বড় দেশগুলোকে বিভ্রান্ত করেন।
তিনি মুখে বলেছিলেন যে, ভবিষ্যতে জার্মানি কোনো আগ্রাসনে লিপ্ত হবে না। কিন্তু ভেতরে ভেতরে তিনি ১৯৩৪-৩৯ সালে যুদ্ধের প্রস্তুতি সম্পন্ন করেন।
আরও পড়ুন...
ভার্সাই চুক্তিতে জার্মানির স্বার্থবিরোধী যেসব ধারা ছিল সেগুলো একে একে অগ্রাহ্য করার নীতি গ্রহণ করেন হিটলার। ১৯৩৩ সালে জার্মানি লীগ অব নেশনস-এর সদস্যপদ ত্যাগ করে।
১৯৩৫ আর অঞ্চল জার্মানির অবিচ্ছেদ্য অংশ হিসেবে ফিরিয়ে নেন। ডানজিগ, মেমেল, সুদেতান অঞ্চলকে জার্মানির অধীন করার প্রচারণায় যুক্ত হন হিটলার।
একই সঙ্গে ইংল্যান্ড ও ফ্রান্সের মধ্যে সন্দেহ সৃষ্টির কৌশল প্রয়োগে হিটলার সফল হন। ১৯৩৬ সালে রোম ও বার্লিনের মধ্যে অক্ষশক্তি আর, তাতে পরে জাপানকে যুক্ত করে হিটলার তার লক্ষ্য অর্জনে অনেকটাই সফল হন।
১৯৩৮ সালে অস্ট্রিয়ার সঙ্গে জার্মানির ঐক্য প্রতিষ্ঠিত হয়। ফলে ইউরোপের বড় বড় দেশগুলো জার্মানির অবস্থানে শঙ্কিত হয়ে পড়ে।
Conclusion:
১৯৩৯ সালের ১ সেপ্টেম্বর পোল্যান্ড আক্রমণের মধ্য দিয়ে হিটলার যে যুদ্ধের সূচনা করলেন তাই শেষ পর্যন্ত দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ নামে পরিচিতি পায়।
এই যুদ্ধ শুরুর পেছনে হিটলারের নাৎসি মানসিকতা প্রধানত দায়ী ছিল। ১৯৪৫ সাল পর্যন্ত এই যুদ্ধ চলেছিল। শেষ পর্যন্ত হিটলারকে হারতে হয়েছিল, জার্মানিকে এর জন্যে চরম মূল্য দিতে হয়েছিল।
Source:
- https://bn.eferrit.com/%E0%A6%A8%E0%A6%BE%E0%A7%8E%E0%A6%B8%E0%A6%BF-%E0%A6%AA%E0%A6%BE%E0%A6%B0%E0%A7%8D%E0%A6%9F%E0%A6%BF-%E0%A6%8F%E0%A6%B0/
- https://encyclopedia.ushmm.org/content/en/article/the-nazi-party-1
- https://en.wikipedia.org/wiki/German_Workers%27_Party
- https://greatwar.nl/books/meinkampf/meinkampf.pdf
- https://encyclopedia.ushmm.org/content/en/article/mein-kampf
- https://www.britannica.com/biography/Ernst-Rohm
- https://www.cbc.ca/player/play/1522116675548
- https://www.bbc.com/news/world-europe-56649935
- https://www.encyclopedia.com/politics/encyclopedias-almanacs-transcripts-and-maps/germany-intelligence-and-security
- https://irp.fas.org/world/germany/index.html
0 Comments